সমস্ত লেখাগুলি

সংবিধান, ধর্মীয় অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে -
বাবাই
Nov. 19, 2024 | আইন | views:881 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভারতবর্ষের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয়। বাবাসাহেব ডঃ বি.আর.আম্বেদকর সংবিধান কিন্তু একা

লেখেননি। সর্বপ্রথমে উনি বেশকয়েকটি দেশবিদেশের সংবিধানগ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালোকরে পড়ে তারপরে সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ২৯৯ জনের মিলিত মতামতে জন্ম সংবিধানের। 


সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন,পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। ১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। প্রসঙ্গত জানাই, এই সংশোধনীর ফলে রাজ্যগুলি নিজেরাই নিজস্ব ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর তালিকা প্রস্তুত করবে এবং তার জন্য ন্যাশনাল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস -এর অনুমতি লাগবে না। এর জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৪২-এ এবং ৩৪২ এ (৩) ধারা সংশোধন করা হয়েছে। 


সংবিধানের শুরুতে সেখানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' বা 'Secular' শব্দটি ছিলোনা। মাননীয়া ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রপতির ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, দেশের নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া দিয়েছে (সংবিধানের ১৪-৩৫ নং ধারা)। যেমন -  (১) সাম্যের অধিকার, (২) স্বাধীনতার অধিকার, (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) ধর্মীয় অধিকার, (৫)সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, এবং (৬) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। 


ধর্মনিরপেক্ষতা' বা 'Secularism' শব্দটা নিয়ে আমজনতার মধ্যেই রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি, সঙ্গে তথ্যবিকৃতিও করা হয়েছে বিশেষ উদ্দ্যেশ্যে। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে। ' Secularism' এর আভিধানিক অর্থ - "An ism does not related with religion and non-entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ কোনো অথবা কারোর পক্ষেই নয় থাকা নয়।তাই ধর্মনিরপেক্ষ মানে মোটেই সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ 'রাষ্ট্র' ('রাষ্ট্র' অর্থে এখানে একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, সাংসদ বিধায়ক, সরকারি আমলা থেকে পাড়ার কাউন্সিলর ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে) কোনো ধর্মের পক্ষেই থাকবেনা, সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। ঠিক যেমনটা একজন রেফারী ইষ্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের মধ্যে ফুটবল খেলায় অথবা ভারত বনাম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় আম্পেয়ার নিরপেক্ষ থেকে খেলা পরিচালনা করেন। 


নির্বাচনে দাঁড়ানো ডান-বাম-ওপর-নীচ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো উক্ত প্রস্তাবনাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকারে "The Representation of the People Act 1951" (Amendment 1989) এর 29(A) ধারায় দায়বদ্ধ। অবশ্য, কার্যক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" এর অবস্থা হতে পারে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক। আইনের প্রয়োগ এবং সদিচ্ছার অভাবে ভারতে গোদীলোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির অপব্যখ্যা ও অপপ্রচার করে, তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছে অনেক আগেই।


এইখানে একটি বিশেষ খবর জানিয়ে রাখা উচিত হবে যে, গত ৩রা জানুয়ারি ২০১৭ তে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিয়েছিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও ভোটের প্রচার করা যাবে না। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। এখন প্রশ্ন এটাই, শীর্ষ আদালতের এই রায় কার্যকর করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, ধর্ম- জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাইলে প্রার্থিপদ বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বড়জোর আদালতে যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে হলে আইন করে কমিশনকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু তা করতে ভয় পায় সব দলই। কারণ ধর্ম, জাতপাতের অঙ্ককে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদের নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রর ঝাঁঝালো বক্তব্য রেখেই কিন্ত ২০১৩ সালে একটি রাজনৈতিক দল ভারতে কেন্দ্রসরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল।


ভারতীয় সংবিধানে ২৫ থেকে ২৮ নং ধারায় আমজনতার ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি রয়েছে, যা আবেগের নয় বরং যুক্তিপূর্ণ আলোচনার বিষয়।ভারতীয় সংবিধান  আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা, কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে, ব্যাক্তিগত ভাবে। অন্যদিকে, ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যের কথাও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, প্রতি ভারতীয় নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে বিজ্ঞান মনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)Part iv A}"।


ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় অধিকার বা ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমজনতার মধ্যে রয়ে গেছে নানানরকম বিভ্রান্তি। অন্যদিকে বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের উচিৎ খুব ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় সংবিধান এবং ভারতীয় আইনের বইপত্র ভালোকরে পড়ে দেখা। আমাদের সংবিধানে এমন বেশকিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো পরস্পরবিরোধী যার সংশোধনের প্রয়োজন আবশ্যক। আবার এমনও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাতে বাধ্য। 


যেমন -১) সংবিধানে বর্ণিত একটি Secular, Democratic, Republic Country ভারতে লাগু রয়েছে শরীয়া আইন (The Muslim Personal Law (Sharia) Application Act, 1937)। ভারতে এটি শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূলতঃ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, অভিভাবকত্ত্ব এর মত বিষয় গুলি শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে এখানে শরীয়া আইন কার্যকরী নয়। মূলতঃ এই আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলিম মহিলারা নিষ্পেষিত ও শোষিত।


২) ব্লাসফেমি অ্যাক্ট। কোনো বিশেষ ধর্মের বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে 'ব্লাসফেমি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের 'Commission on International Religious Freedom' এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১টি দেশের তালিকা উঠে আসে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 


বহুর মধ্যে একটা মর্মান্তিক শোনা যাক। সম্ভবত আগষ্ট ২০২১ এর ঘটনা, ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তানে আটক একটি হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী পরিবারের ৮ বছরের ছেলে মৃত্যদন্ডে দণ্ডিত। যে বয়সের শিশুরা জানেই না ধর্ম নামক জিনিসটা খায়, নাকি মাথায় মাখে সেই বয়সের একটি শিশু কিভাবে ধর্ম অবমাননা করতে পারে? সে কিভাবেই বা অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করতে পারে? 


দন্ডবিধি ১৮৬০, অনুচ্ছেদ ১৫র ২৯৫ ধারা থেকে ২৯৮ ধারা (IPC-295-298) পর্যন্ত সংশোধন করা প্রয়োজন এবং এর মধ্যে ২৯৫-ক (IPC-295A) ধারাটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা খুবই প্রয়োজন। সংবিধান প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী এই আইন। আলোচনা, সমালোচনা, মতপ্রকাশ এবং  উস্কানি, বিদ্বেষ, ঘৃণাবাদ এক নয়  অন্যদিকে, দন্ডবিধি-১৮৬০ এর পঞ্চদশ অধ্যায়ের ২৯৫-ক ধারাটিতে আলোচনা, সমালোচনা, বাক্ স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে।


৩) ভারতীয় সংবিধানের ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, 'No religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.'অর্থাৎ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনোরকম ধর্মীয় নির্দেশ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা যাবেনা। আবার, ২৮(২) নং ধারায় লেখা হয়েছে- 'Nothing in clause 28(1) shall apply to an educational institution which is administered by the State but has been established under any endowment or trust which requires that religious instruction shall be imparted in such institution.' ফলে কনভেন্ট স্কুল বা মিশনারি স্কুল কিংবা বৈদিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এই স্ব-বিরোধীতা সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন। 

ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত কয়েকটি মৌলিক অধিকার -
বাবাই
Nov. 19, 2024 | আইন | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অনেকেই, বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর কে ভারতীয় সংবিধানের জনক হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। উনি ছিলেন সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান। সর্বপ্রথমে আম্বেদকর মহাশয় বেশকয়েকটি দেশের সংবিধানগ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালোকরে পড়ে তারপর সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ২৮৪ জন সাক্ষর করলে এটি গৃহীত হয়। এই দিনটি "জাতীয় আইন দিবস" হিসেবে পরিচিত। গণপরিষদ সংবিধান রচনা করতে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় নিয়েছিল। এই সময়কালের মধ্যে ১৬৬ দিন গণপরিষদের অধিবেশন বসে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার স্মৃতিতে ২৬ জানুয়ারি তারিখটি সংবিধান প্রবর্তনের জন্য গৃহীত হয়েছিল। 

১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন কার্যকরী হয়। এই আইনবলে ব্রিটিশ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়। স্থির হয়, সংবিধান প্রবর্তন পর্যন্ত এই দুই রাষ্ট্র কমনওয়েলথ অফ নেশনসের দুটি অধিরাজ্যের মর্যাদা পাবে। এই আইনবলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে ভারত ও পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং উভয় রাষ্ট্রের উপর সংশ্লিষ্ট গণপরিষদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান প্রবর্তিত হলে পূর্বপ্রচলিত ১৯৩৫ সালের ভারতের শাসন আইনেরও অবসান ঘটে এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন প্রত্যাহৃত হয়। এরপরে ভারত ব্রিটিশ রাজশক্তির অধিরাজ্যের বদলে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা অর্জন করে। 

ভারতের সংবিধান, বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধানে মোট ২৪টি অংশে ৪৪৮টি ধারা, ১২টি তফসিল এবং ১১৩টি সংশোধনী বিদ্যমান। ভারতের সংবিধানের ইংরেজি সংস্করণে মোট শব্দসংখ্যা ১১৭,৩৬৯।  দেশের সর্বোচ্চ আইন হওয়ার দরুন, ভারত সরকার প্রবর্তিত প্রতিটি আইনকে সংবিধান-অনুসারী হতে হয়।

সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন,পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। প্রথম সংশোধন হয়েছিল সংবিধান চালু হবার পরের বছরেই, অর্থাৎ ১৯৫১ সালে। প্রসঙ্গত জানাই, ভারতের সংবিধান সংশোধনের জন্য বিল একমাত্র সংসদেই উত্থাপন করা যায়। সংসদের যে-কোনও কক্ষেই এই বিল উত্থাপন করা যায়। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত কোনও বিল উত্থাপন করা যায় না। কেন্দ্রীয় সরকার বা সংসদের যে-কোনও কক্ষের যে-কোনও সাংসদ বিলের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন। সরকার যে বিল উত্থাপন করেন তা সরকারি বিল এবং কোনও সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে যে বিল উত্থাপন করেন তা বেসরকারি বিল হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। তাছাড়া, ভারতের সংবিধানের সকল অংশকে একই পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না। গুরুত্ব অনুসারে বিভিন্ন অংশের সংশোধনীর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। 

১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্বারা স্বাক্ষরিত ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। 

সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।

এবারে দেখে নেওয়া যাক সংবিধান আমজনতাকে কিধরনের মৌলিক অধিকার দান করেছে। সংবিধানের তৃতীয় অংশে ১২-৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। এই মৌলিক অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে মুল সংবিধানে ৭ টি মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ ছিল। সেগুলি হল- 

১) সাম‍্যের অধিকার (১৪-১৮ নং ধারা)

২) স্বাধীনতার অধিকার (১৯-২২ নং ধারা)

৩) শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার (২৩-২৪ নং ধারা) 

4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫-২৮ নং ধারা)

৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার (২৯-৩০ নং ধারা)

৬) সম্পত্তির অধিকার (৩১ নং ধারা)

৭) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার (৩২ নং ধারা) 

বর্তমানে মৌলিক অধিকারের সংখ্যা ৬ টি। (এইখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, ১৯৭৮ সালে ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ‍্যমে সম্পত্তির অধিকার কে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে  বর্তমানে সম্পত্তির অধিকার ৩০০এ ধারায় সংযোযিত রয়েছে) যেমন- 

১) সাম‍্যের অধিকার:

(ক) সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং আইন সবাইকে সমানভাবে রক্ষা করবে। 

(খ) সংবিধানের ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের সাথে ধর্ম, জাতি, বর্ন, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বেষম‍্যমুলক আচরন করতে পারবে না। 

(গ) সংবিধানের ১৬ নং ধারা অনুসারে সরকারি চাকুরি তে সব নাগরিকদের সমান সুযোগসুবিধা থাকবে।

(ঘ) সংবিধানের ১৭ নং ধারা অনুসারে অস্পৃতাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষনা করা হয়েছে।

(ঙ) সংবিধানের ১৮  নং ধারার সামরিক শিক্ষাক্ষেত্র ছারা সমস্ত ক্ষেত্রে উপাধি গ্রহন ও ব‍্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

২) স্বাধীনতার অধিকার: 

সংবিধানের ১৯ নং ধারায় নাগরিকদের ৬ প্রকার স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন- 

(ক) বাক স্বাধীনতার অধিকার

(খ) শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশ 

(গ) সঙ্ঘ ও সংবিধানের ২০ (১) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে কেবলমাত্র সেই আইন অনুসারেই শাস্তি প্রদান করতে হবে।

সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে এক‌ই অপরাধের জন‍্য একাধিকবার শাস্তি প্রদান করা যাবে না। 

সংবিধানের ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে নিজের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ দিতে বাধ‍্য করা যাবে না।

সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে তার জীবন ও ব‍্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

২০০২ সালের ৮৬ তম সংবিধান সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে শিক্ষার অধিকার আইনটি (২১এ ধারা) সংবিধানে সংযোযিত হয়েছে। এই ধারায় সকল শিশুদের জন‍্য অবৈতনিক ও বাধ‍্যতামুলক শিক্ষার ব‍্যবস্থা করবে। 

২২ নং ধারা অনুসারে কোন ব‍্যক্তিকে যুক্তি সংগত কোন কারণ ছারা গ্রেফতার করা যাবেনা। 

৩) শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার: 

সংবিধানের ২৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, মানুষ নিয়ে ব‍্যবসা অর্থাৎ মানুষ ক্রয় বিক্রয়, বেগার খাটানো বা অনুরুপ ভাবে বলপূর্বক শ্রমদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সংবিধানের ২৪ নং ধারায় ১৪ বছ‍রের কম বয়সী শিশুদের খনি, কলকারখানা বা অন‍্য কোন বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

৪) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার: 

সংবিধানের ২৫  নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত‍্যেক ব‍্যক্তি নিজের বিবেক এবং বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোন ধর্ম গ্রহন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও নিজ ধর্ম প্রচার করতে পারবে।

সংবিধানের ২৬  নং ধারায় বলা হয়েছে প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের ধর্ম প্রচারের জন‍্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষনাবেক্ষন ও পরিচালনা করতে পারবে।

সংবিধানের ২৭  নং ধারায় বলা হয়েছে কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির এবং রক্ষনাবেক্ষণের জন‍্য কোন ব‍্যক্তিকে কর বা চাঁদা দিতে বাধ‍্য করা যাবে না। 

সংবিধানের ২৮  নং ধারায় বলা হয়েছে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত সেগুলিতে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া যাবেনা। 


৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার: সংবিধানের ২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, ভারতীয় ভুখন্ডের যেকোন অংশে বসবাসকারী নাগরিক নিজ নিজ ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি সংরক্ষনের অধিকার ভোগ করতে পারবে। 

সংবিধানের ৩০ নং ধারায় বলা হয়েছে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ‍্যালঘু সহ সকল সংখ‍্যালঘুদের নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। 


৬) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার: সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার টি কে, ড. বি আর আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা বলে আখ্যায়িত করেছেন। 

সংবিধানের ৩২নং ধারায় বলা হয়েছে ভারতীয় নাগরিকরা যদি মনে করেন যে তাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বা খর্ব করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হতে পারেন। 


এছাড়া সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রপতি, ২০ এবং ২১ নং ধারা ব‍্যতীত সমস্ত মৌলিক অধিকার গুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে স্থগিতাদেশ দিতে পারেন। 

সংবিধানের ৩২ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট, ২২৬ নং ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার গুলি রক্ষার জন‍্য পাঁচ ধরনের লেখ বা রিট জারি করতে পারেন। যেমন- 

(ক) বন্দী প্রত‍্যক্ষীকরন (Habeas Corpus): এর অর্থ হল To have the body অর্থাৎ "সশরীরে হাজির করা"। 

(খ) পরমাদেশ (Mandamus): এর অর্থ হল Command to. 

(গ) প্রতিষেদ (Prohibition): এর অর্থ হল "নিষেধ করা"। 

(ঘ) উৎপ্রেশন (Certiorari) এর অর্থ হল "বিশেষভাবে জ্ঞাত হ‌ওয়া"।

(ঙ) অধিকার পৃচ্ছা (Quo Warranto) এর অর্থ হল "কোন অধিকারে"।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929