গল্পের ফাঁকফোঁকর : গ্রাহাম গ্রীন কি মহাভারত পড়েছিলেন ?

Guitar K Kanungo


Jan. 11, 2025 | | views :31 | like:2 | share: 1 | comments :0
এই প্রশ্নটা প্রথমে শুনতে অবান্তর শোনাবে কিন্তু গ্রাহাম গ্রীনের একটা উপন্যাসে আলোচিত একটা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব তখন আর সেরকম মনে হবে না। শুরুতেই গ্রাহাম গ্রীন সম্পর্কে কিছুটা বলে নিই।
গ্রাহাম গ্রীন ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। সাহিত্য সমালোচকরা বলে থাকেন তাঁর সাহিত্যকর্মে মূলত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, নৈতিকতার প্রশ্ন, এবং মানুষের মানসিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে "দ্য পাওয়ার অ্যান্ড দ্য গ্লোরি", "দ্য হার্ট অব দ্য ম্যাটার", "দ্য কুইয়েট আমেরিকান", এবং "দ্য এন্ড অব দ্য অ্যাফেয়ার"। "দ্য টেন্থ ম্যান" তার একটি উল্লেখযোগ্য ছোট উপন্যাস, যেখানে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের নৈতিক দ্বিধা ও আত্মত্যাগের বিষয়গুলি গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই শেষের উপন্যাসটা অর্থাৎ "দ্য টেন্থ ম্যান" নিয়েই আমাদের আলোচনা।
এই উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্ছিত্র নির্মিত হয়েছে। এন্থনি হপকিন্স কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মূলত এই ছবিটা দেখেই আমার মধ্যে গ্রাহাম গ্রীন মহাভারত পড়েছেন কিনা প্রশ্নটা জেগেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়। জ্যাঁ-লুই শাভেল অধিকৃত ফ্রান্সের প্যারিস শহরের একজন ধনী আইনজীবী। একজন সেনা জার্মান কর্মকর্তাকে খুন করার অভিযোগে শাভেল যে শহরে বসবাস করতেন সেই শহরের কিছু পথচারীকে জার্মান বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এই মানুষগুলো কোনভাবেই ওই সেনা কর্মকতা হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না কিন্তু জার্মানবাহিনী অধিকৃত ফরাসি দেশের মানুষকে একটা শিক্ষা দিতে চাইছিল। এই তুলে নিয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যে ঘটনাচক্রে জ্যাঁ-লুই শাভেলও ছিলেন।
আইনজীবি এবং আর্থিক অবস্থার কারণে জ্যাঁ-লুই শাভেল নিজেকে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ বলে মনে করতেন। মনে করার কারণও একটা অসংগত নয়। তাঁর তখনকার দিনের হিসাবে বেশ ভালো পরিমানের অর্থ ব্যাংকে জমা রাখা ছিল। তিনি থাকতেন ছোটখাট একটা প্রাসাদের মত বাড়িতে। যাইহোক, জার্মান বাহিনী তাঁর সামাজিক অবস্থান নিয়ে কোন রকমের আগ্রহই দেখালো না। তাঁকে অন্যসব সাধারণ পথচারীর সঙ্গে কারারুদ্ধ করে রাখা হল। শুরুতে কিছুটা অসুবিধা হলেও জ্যাঁ-লুই শাভেল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হলেন।
কিছুদিন পর জার্মান বাহিনীর তরফে একজন সেনা কর্মকর্তা ওই কারাগার পরিদর্শনে এলেন। এসেই বললেন সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে পরের দিন তাঁদের ভেতর থেকে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হবে। বন্দিরা নিজেরাই যেন ঠিক করে নেয় কারা হবে সেই তিনজন। বন্দিদের মধ্যে একজন ছিল বয়সে বেশ কিছুটা প্রবীণ। তিনি বললেন তাঁর জীবনে খুব একটা বেশি সময় এমনিতেই নেই। তিনি তিনজনের একজন হতে রাজী হলেন। কিন্তু বাকী দুজন? অন্যদের মধ্যে কেউ যে মরতে চায় না। জ্যাঁ-লুই শাভেল তো নয়ই। কিন্তু উপায় কী ?
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল একটা লটারীর ব্যবস্থা করা হোক। যতজন কারাবন্দী আছে ততটা ছোট ছোট কাগজের টুকরো জোগাড় করা হল। সেই টুকরোগুলোর কেবল তিনটেতে এক্স চিহ্নটি লিখে সবগুলি কাগজে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হল যাতে কীয় বুঝতে না পারে কোন কাগজে এক্স চিহ্নটি দেয়া আছে। এরপর সবাইকে একটি একটা কাগজের টুকরো তুলতে বলা হল। যে তিনজন এক্স চিহ্নিত কাগজ তুলবে সেই তিনজনই পরের দিনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকবে। যে বুড়ো শুরুতেই প্রাণ দেয়ার জন্যে রাজী হয়েছিল তার ভাগ্যে এক্স চিহ্নিত কাগজই জুটল। আর জুটল জ্যাঁ-লুই শাভেলের ভাগ্যে যিনি কোন অবস্থাতেই মরতে চাইছিলেন না।
ঠিক এই জায়গায় এসে আমার মহাভারতে বর্ণিত মহারাজ যযাতির কথা মনে পড়ে গেল। যযাতির স্ত্রী ছিলেন অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী। এই দেবযানীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠেছিলেন ঘটনাচক্রে তাঁর দাসীতে পরিণত হওয়া অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। যযাতি কামুক পুরুষ ছিলেন। শর্মিষ্ঠা দাসী হলেও রাজকন্যা ; তার উপর যযাতির চোখ পড়ল। শর্মিষ্ঠার তরফেও খুব একটা আপত্তি ছিল না। কিন্তু দেবযানীর ভীষণ রকমের আপত্তি ছিল - সঙ্গতকারণেই। অতএব দক্ষের মেয়েদের মত দেবযানী ছুটে গেলেন পিতা শুক্রাচার্য্যের কাছে স্বামী যযাতির বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে। শুক্রাচার্য্যের অভিশাপ নেমে এলো যযাতির উপর- তিনি জরাগ্রস্থ হবেন।
যযাতির মত কামুক একজন রাজার কাছে জরাগ্রস্থ হওয়া মৃত্যুরই সামিল। তিনি স্বশুরমশাইয়ের হাতে ধরে একটা উপায়ের ব্যবস্থা করলেন। তিনি চাইলে অন্য কারো সঙ্গে তাঁর জরা বদল করতে পারবেন। তিনি কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর সঙ্গে তাঁর জরা বদল করে আরো বেশ কিছু সময় যৌবনকে উপভোগ করে গেছেন। তারপর পুরুর কাছ থেকে জরা ফিরিয়ে নেন। বিনিময়ে অন্যপুত্রদের বঞ্চিত কে তিনি পুরুকেই তাঁর রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।
জ্যাঁ-লুই শাভেল ঠিক এই কাজটাই করলেন। তিনি মরতে চান না কোনভাবেই কিন্তু তার ভাগ্যে এসে পড়েছে এক্স চিহ্নিত কাগজের টুকরো। তিনি যযাতির মত ঘোষনা দিলেন কেউ যদি তার কাছ থেকে ওই কাগজের টুকরো নিয়ে নিজে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় তাহলে তাঁকে তিনি এক লক্ষ ফ্রাংক দেবেন। কেউ রাজী হলো না। শেষে তিনি তাঁর জীবনের মূল্য আরেকটু বাড়ালেন। বললেন তাঁর বাড়ী এবং ব্যাঙ্কে সঞ্চিত অর্থের বিনিমিয়ে কীয় তাঁর সাথে এই ডিল করতে চায় কিনা।
এক তরুণ এই প্রস্তাবে রাজী হল। তার এমনিতেই সহায় সম্পত্তি বিশেষ কিছু নেই। মৃত্যকে বেছে নিয়ে সে তাঁর বিধবা মা এবং একমাত্র বোনের জন্য একটা বাড়ী আর বেশ কিছু অর্থ অন্তত রেখে যেতে পারবে। যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরুও কি পিতার জরা গ্রহণ করতে গিয়ে একথাটা ভেবে দেখেনি ? নিশ্চয়ই দেখেছে। পুরুর অন্য ভাইরা পিতার ইচ্ছেয় সম্মতি না দিয়ে নিজেদের ভবিষতের গোড়ায় জল ঢেলে দিয়েছে ইটা না বোঝার মত বুদ্ধি পুরুর ছিল না এমন ভাবার কোন কারণ নেই। সেইজন্যে ভাবছিলাম গ্রাহাম গ্রীন কি মহাভারত পড়ে এই ধারণাটা পেয়েছিলেন ?

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86939