(১) কিছু একান্ত কথা
প্রশ্ন হইল, আমরা কি কেবলমাত্র তমসাচ্ছন্ন পথকেই আশ্রয় করিব? আমাদিগের সকল বিষয় ও বাসনারাশি রাজনীতি,ধর্মীয় কুসংস্কারের নিকট সমর্পণ করিয়া, তাহার অন্ধকারবৃত্তের অভিমুখে অগ্রসর হইব?
আমরা কি দৈহিক স্থূল আবেগের অনুবর্তী, না হইতে পারি না?
সকল শক্তি সংহত করিয়া অন্তঃস্থ শুদ্ধ চৈতন্যের দ্বারা পরিচালিত হইতে পারি না?
এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রতিটি মানুষের অতি একান্ত, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ হইতেই উৎসারিত হইয়া থাকে।
বিজ্ঞানী যেরূপ গবেষণাকার্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রসমূহ উদ্ভাবন করিয়া থাকেন। সেইরূপ সকল আনুসন্ধানিক কার্যেই কিছু সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হইয়া থাকে। উচ্চতর গবেষণাকার্যে একমাত্র চেতনাযুক্ত মন-ই এমন এক উপযুক্ত যন্ত্র।
দৈনন্দিন জীবনে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এমন এক কুসংস্কারমুক্ত চেতনাযুক্ত, মন প্রয়োজন। যা আমাদিগের স্থূল-দৃষ্টি বহির্ভূত বিষয়সকল উদ্ঘাটন করিতে সাহায্য করিবে।
তাই নয় কি? ভাবুন ভাবুন ভাবা প্র্যাকটিস করুন...
(২) চতুর
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
এক সময়ে একজন ধর্মীয় গুরু আমাদের প্রতিবাসী হইয়া আসিলেন। সকলকে ধর্ম সম্বন্ধে উৎসাহী করা তাঁহার প্রধান কর্ম ছিল। যেখানে কেহ একা আছে দেখিতেন, সেইখানে গিয়া গল্পকথা আরম্ভ করিতেন; কেহ তাঁহার কথা শুনিত, কেহ শুনিত না। অথচ তাঁহার স্থির বিশ্বাস ছিল যে, সকলেই তাঁহার কথা শুনিতে আগ্রহ করে।
একবার একজন শ্রোতা কৌতুহলী হইয়া বলিয়াছিলেন, "আপনার গল্পকথা ভাল লাগে,তবে উহাসকল প্রমাণিত করিতে পারিবেন?"
গুরু ঠাকুর উত্তর করিয়াছিলেন, “তা কেমন করিয়া হইবে, এখনও যে এ কথার অনেক বাকি। তুমি চুপ কর।”
বিনা মেঘে হঠাৎ করিয়া এমন গুরুতর আলোচনার মধ্যে, অমন প্রশ্নের অবতারণায় গুরুঠাকুর বোধহয় কিঞ্চিৎ হতবিহ্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। পাশ থেকে এক ভক্ত কহিলেন, "বুঝিতে পারিলেন না, বাবা অন্তর্যামী! আপনি মুখ খুলিবার পূর্বেই আপনার আসিবার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্যক অবগত হইয়া বসিয়া আছেন।" তবুও কথাগুলি প্রশ্নকারীর মনে ধরিল না। দুরু দুরু বক্ষে তিনি একটা প্রশ্ন করিতে যাইবেন, এমতাবস্থায় বাবা নাসিকা গর্জনের সহিত গভীর ধ্যানে তলাইয়া গেলেন। প্রশ্নকর্ত্তা আর মুখ খুলিতে সুযোগ পাইলেন না। ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় ফ্যালফ্যালাইয়া শূন্য দৃষ্টিতে মহাজ্ঞানী মহাজনের জাগিবার অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না, বাবা চক্ষু উন্মোচন করিয়া ভক্তগণের দিকে চোখ রাখিয়া, পুনরায় তাঁর বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন।
কিছুসময় পর, গুরুদেব পুনরায় দৃষ্টির ঝাঁপ অবনত করিলেন। প্রশ্নকারীর কৌতুহলী হৃদয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই এই ধারণা বাসা বাঁধিতে শুরু করিয়াছিল যে, ভাগিয়া যাওয়া ছাড়া তাহার সম্মুখে হয়ত আর কোন রাস্তা খোলা নাই। কিন্তু বাকীদের কী করিয়া উহাতে রাজী করাইবেন! সে নিজে সত্যের জন্য জীবন পর্যন্ত বিলীন করিতে প্রস্তুত থাকিলেও, বাকিরা যে ধর্মগুরুর প্রতি অনুরাগী! তাহারা কি তাহাদের অন্ধবিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া এক সাথে পথে নামিতে উৎসাহী হইবে!? যদি অবাস্তববাদী চিন্তায় প্রভাবিত হইয়া বাকিরা ভাগিয়া যাইবার পরিকল্পনাকে খারিজ করিয়া দেয়! তাহা হইলে তাহাদের মনের চাবি ভাঙ্গিয়া, তাহাদেরকে দুঃসাহসী রোমাঞ্চভিলাষীতে পরিণত করিবার আর কোন কার্যকর পন্থা কি উন্মুক্ত থাকিবে?
আবারও দৈববাণীর ন্যায় গুরুঠাকুরের মুখ হইতে ধ্বনিত হইল,-"ধর্মে প্রশ্নের স্থান নাই!" বলিয়া শুন্য হইতে একখানি তাম্বুল করগত করিয়া, ভক্তদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়িয়া দিলেন।
‘অ্যাঃ’—বিস্মিত প্রশ্নকর্তা আর কোন শব্দ খুঁজিয়া পাইলেন না।
এমন সময়ে তিনি দেখিলেন,দর্শকাসন হইতে জাদুকরের ন্যায় একজন বড় পাগড়ী ও আলখাল্লা পরিহিত কোন এক ব্যক্তি, ধর্মগুরুর নিকট সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। তাহাকে গোষ্ঠীর দলপতির দরবারে লইয়া যাওয়া হইল। দলপতি অর্থাৎ গুরুঠাকুর পরম সমাদরে গাত্রোত্থান করিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিলেন। এবং তাহাকেও শুন্য হইতে তাম্বুল আনিয়া দিলেন।
বিস্মিত শ্রোতা দেখিলেন, অদ্ভুতভাবে জাদুকরও অবিকল সেইরূপ অঙ্গভঙ্গি করিয়া প্রতিকর্ম দেখাইলেন। এবং তিনিও ধর্মগুরুর হাতে, শুন্য হইতে একখানি তাম্বুল লইয়া ধরাইয়া দিলেন। ইহা দেখিয়া অপ্রকৃতস্থ হইয়া, ধর্মগুরু সস্নেহে জাদুকরের হাতখানি টানিয়া লইলেন। এবং ধীরে ধীরে তাহাকে অতি সুন্দর ভাবে কহিলেন, "তুমি যাহা করিলে, উহাতেও আমার ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল বলিয়াই, তাহা সম্ভব হইল!"
সব দেখিয়া বুঝিয়া, সেই শ্রোতার অন্তরাত্মা শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু পাছে অসভ্যতা হয়,তাই বাহ্যিক কিছু প্রকাশ করিলেন না। গুরুঠাকুরের কথা শুনিয়া জাদুকর হাসিয়া নিবৃত্ত হইবা মাত্র, গুরুঠাকুরের একজন শিষ্য তাহার হাতখানি টানিয়া লইয়া যাইয়া, শিক্ষিত প্রণালী অনুসারে যথাসাধ্য সদ্ভাব জ্ঞাপন করিলেন। গুরুদেবের এই ঐশী ব্যবহারে উপস্থিত সকলেই যারপরনাই খুশি হইলেন এবং জাদুকরের প্রস্থানের পর তাহাদের ভক্তিযোগেও আর কোন গোল রহিল না।