"ভোট"-কথাটা শুনলেই কেমন যেন অকাল উৎসব, কোথাও আসন্ন ভীতি আবার কোথাওবা টি-আর-পি বাড়ানোর খেলার অনুভূতি জাগে। পৃথিবীর সবথেকে বড় গণতন্ত্র এই ভারত, আর সেই ভারতের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব এই নির্বাচন। সত্যিই কি তাই? গণতন্ত্রের প্রভাবকে অমলিন রাখতে কি সক্ষম এই ভোট? আলোচনা করা যাক...
দেশের ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করুন গণতন্ত্র কী?খায় না মাথায় দেয়? ৯৯ জন অকপটে জানাবে "এই যে ভোট দিই আমরা"!, মানে এই ভোট দিয়েই তারা সন্তুষ্ট, ভোটের দিন ওই একদিনের রাজকীয় অনুভূতিতেই তারা খুশি, ঠিক এর বিপরীতে একটা ছবিও আছে, যেখানে ভোট আসছে শুনলে নিরীহ পাড়াটা তটস্থ হয়ে ওঠে আসন্ন খুনোখুনি, সন্ত্রাসের ভয়ে, বৃদ্ধা মাকে নিজের ছেলেকে হারানোর ভয় আঁকড়ে ধরে। এইসব নির্বাচনী হিংসার কোনটার পিছনে যে কে বা কারা থাকে তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক তরজা আর মিডিয়ার প্রচারে সাধারণ মানুষের কাছে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। মিডিয়াও নেমে পড়ে ঘটনাকে মশলা সহযোগে কে কত রোমাঞ্চকর ভাবে পরিবেশন করতে পারে তার খেলায়, যত রক্তপাত হবে, যত মায়ের কোল খালি হবে প্রাইমটাইমের টি আর পি তত বাড়বে, ফলত, তাদের কাছে এ এক দারুণ উৎসব, খেলা।
ক্রিকেট মোটামুটি আমরা সবাই দেখি, আই পি এল নামের একটা ক্রোড়পতি লিগ কারোরই অজানা নয়, আমরা কী দেখি? কিছু দলের লড়াই চলছে ট্রফির আশায়, আর যেটা দেখি না সেটা হল প্রত্যেকটা দলের পিছনে বসে আছে কিছু ইনভেস্টর, যারা টাকা ঢেলেছে এক একটা দলের পিছনে। সেই দল ট্রফি জিতলে তার শেয়ার ভ্যালু, বিজ্ঞাপন ভ্যালু এটার থেকে বিপুল লাভ আসবে ইনভেস্টরের পকেটে, তাই আই পি এল যে কোনো মূল্যে করানো চাই-ই, তা সে করোনায় দেশবাসী যতই অনাহারে মরুক লকডাউনে। খেয়াল করলে দেখবেন, ভোটও তাই, করোনার গ্রাফ দৈনিক ৩ লাখ ছাড়ালো, কিন্তু ভোট স্থগিত? নৈব নৈব চ, এখানেও কারণটা খুব সহজ, রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগেরই শিল্পপতি ইনভেস্টর থাকে যারা বিপুল টাকা পার্টি ফান্ডে ঢালে, লক্ষ্য? ওই, ক্ষমতায় এলে তাদের সুবিধা করে দেওয়া। ভোট স্থগিত হলে, এত হাজার কোটির ইনভেস্টমেন্ট সব ভেস্তে যাবে যে!!
ভোট যখন হচ্ছেই তখন জনগণের মগজধোলাই না হলে চলবে কীভাবে? অতএব সমাবেশ, মিটিং মিছিল সব চলবে....আর সেই সার্কাস দেখতে ভিড়ও হবে... প্রধানমন্ত্রী রাতে ভাষণ দেবেন সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মানার পরদিন সকালে সমাবেশে আসবেন হেলিকপ্টারে চড়ে, তবুও লোকজন বেশ খুশি, মুখিয়ে থাকবে শুনতে কোন নেতা কার নামে কী চটুল মন্তব্য করল...আর খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ঠাঁই পায় এই কাদা ছোড়াছুড়ি গুলোই। বিক্রি বাড়াতে হবে না??
আচ্ছা, উৎসব মানে আমরা কী বুঝি? পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রদ্ধা, শালীনতার সীমায় থাকা। কিন্তু হায় এই উৎসবে যদি সেটা আশা করেন আপনি তবে সোনার পাথরবাটির আশায় আছেন।জাতপাত, ধর্ম, উন্নয়ন, সব কিছুই হয় প্রচারের হাতিয়ার। প্রত্যক্ষ গালিগালাজ থেকে শুরু করে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে লোকজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলায় সব দলের জুড়ি মেলা ভার,শীতলকুচিতেই দেখুন, কেউ বলে বাহিনীর দোষ, কেউ বলে মমতার উস্কানিতেই ঘটেছে, কারণ যাই হোক তৃণমূল বিজেপি কোনো পক্ষই কিন্তু মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করতে ছাড়েনি..., একে অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে চাপা পড়ে গেছে বাবা হারা মেয়েটা, বা ছেলে হারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, হয়তো স্বামী হারা মেয়েটা টিভিতে দেখলো হেডলাইন, "শীতলকুচি নিয়ে কী বললেন বিজেপির মুখপাত্র, পাল্টা কী বললেন মমতা? জানতে হলে আজ রাত ৮ টায়"...টি আর পি কা খেল মশাই টি আর পি!!
ভোটের দিনগুলোতে নেতাদের পারলে পা ধরে জড়িয়ে পরবে এমন ভাব থাকে, ফ্ল্যাটে থাকা স্বচ্ছল প্রার্থী নেমে এসেছে পথের ধুলোয়, মাথা নীচু করে ঝুপড়ি গুলোতে
ঝুঁকে পড়ছে, চকচকে পাঞ্জাবি ছেড়ে "আমি তোমাদেরই লোক" প্রমাণে নিজেদের পাঞ্জাবিতে পথের ধুলো লাগাতে ব্যস্ত। এও এক সার্কাসের অঙ্গ।
এমনি করে ভোট আসে ভোট যায়, সার্কাস,সন্ত্রাস, উৎসব একসাথে চলে, একদল ক্ষমতায় আসে আরেকদল বিদায় নেয়, কিন্তু ক্ষমতার মুখগুলো থেকে যায় একই, ঋতুবদল, দিনবদলের মতো দলবদলও এ সার্কাসের এক্স ফ্যাক্টর,
ফলে কী হয়, সার্কাসে জোকার গুলোর বেশভূষা পাল্টায়, আজ লাল জামা, কাল সবুজ তো পরশু গেরূয়া পোশাক.. কিন্তু জোকারের মুখগুলো থেকে যায় একই....তাই এ সার্কাসেও একই খেলা চলতে থাকে দিনের পর দিন।।