মৃত্যু এক চিরন্তন সত্য, যা গ্রহণ করা অত্যন্তই কঠিন। যে কোনো মৃত্যু মাত্রই তার নিকটস্থের কাছে তা শোকবিহ্বল। এই মৃত্যু যদি অকালে হানা দেয় দেহে, তবে তা আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। এক গভীর শূণ্যতা সৃষ্টি করে দিয়ে যায় মৃত্যু।
এই মৃত্যু ঘটে দুইভাবে। এক, সাধারণ মৃত্যু যাকে বলা হয় কার্ডিও রেসপিটরি ফেলিয়র যা ঘটে কোন অসুখের কারণে। দুই, ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্ক কান্ডের মৃত্যু যা ঘটে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণের ফলে।
কিন্তু, মৃত্যু যেমন এক কঠিন সত্য; তেমনি এই মৃত্যুই পারে অন্য কোনো মৃত্যু পথগামীর জীবনে জীবনের আলো বয়ে আনতে। মৃত্যু হয়ে উঠতে পারে জীবনদায়ক। স্বাভাবিকভাবেই, আমরা দেখে থাকি মানুষেরা মারা গেলে তাদের নিজস্ব ধর্মানুসারে হয় পুড়িয়ে ফেলে, দাফন্ করে, বা আরও অন্যান্য ভাবে মৃতদেহকে নষ্ট করা হয়। তাদের কাছে মৃতদেহ যেনো একটা সামাজিক আবর্জনা স্বরূপ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মৃতদেহ একটি সম্পদ চিকিৎসাশাস্ত্রে। মৃতের শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ(Organs)ও কলা (tissues) সংগ্রহ করে মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানবদেহের মধ্যে তা প্রতিস্থাপন করা যায়।
একমাত্র মৃত ব্যক্তির সক্রিয় ও উপযুক্ত অঙ্গ সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসক’রা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দাতা অরগ্যান বা টিস্যু সংগ্রহ সম্ভব কিনা যাচাই করে নেবেন।
মৃতদাতার ক্ষেত্রে যে বয়স সীমা মেনে চলা হয় তা হলো, কিডনি, লিভার: ৭০ বছর পর্যন্ত। হার্ট, ফুসফুস: ৫০বছর পর্যন্ত। প্যানক্রিরিয়া, অন্ত্র: ৬০-৬৫ বছর পর্যন্ত। কর্ণিয়া, ত্বক: ১০০ বছর পর্যন্ত। হার্ট ভালভ: ৫০ বছর পর্যন্ত। অবহাড়: ৭০ বছর পর্যন্ত। অবশ্যই কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটে। এর পরবর্তী প্রশ্ন আসবে মৃত দাতার থেকে গৃহীত প্রত্যঙ্গগুলি কত তাড়াতাড়ি প্রতিস্থাপন করা উচিত?
হার্ট ও হার্ট ভালভ (৪ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে)। ফুসফুস (৪ থেকে ৮ ঘন্টার মধ্যে)। ইনটেন্সটাইন (৬ থেকে ১০ ঘন্টার মধ্যে)। লিভার (১২ থেকে ১৫ ঘন্টার মধ্যে)। প্যানক্রিয়াস (১২ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে)। কিডনি (২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে)। এই বিস্তারিত আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার যে মৃত্যুর আমাদের মরদেহ হয়ে উঠতে পারে নব জীবনদানের আধার। জীবিতকালে আমরা নিজের নির্বাচিত কোন ব্যাক্তিকে আমার নিজের কিছুটা লিভার, একটি কিডনী এবং রক্ত দিতে পারি। অন্যকিছু নয়। কিন্তু মরণোত্তর কলা বা প্রত্যঙ্গদানের ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচিত কোন ব্যাক্তিকে তা পারিনা।
এক্ষেত্রে আমাদের একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার রক্ত বা কলা কিংবা প্রত্যঙ্গ কোনভাবেই কেনা বা বেচা যাবে না। যা আইনবিরুদ্ধ। এই মর্মে, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতিকল্পে গত ১৪ই আগস্ট, ২০২২ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ (উদয়নারায়ণপুর বিজ্ঞান কেন্দ্র), উদয়নারায়ণপুর ব্লকের ডিহিভূরসুট অঞ্চলে একটি মরণোত্তর চক্ষুদান-দেহদান শিবির আয়োজন করে। এই শিবিরে ৫২জন চক্ষুদান করেন ও ৬ জন করেন দেহদান। এই প্রগতিশীল দাতা'রা জন্মান্তরবাদের মিথ্যা ধারণাকে নস্যাৎ করে এগিয়ে এসেছেন এই কর্মকাণ্ডে। তাঁরা বুঝেছেন জন্মান্তরের কথা আসলে ভন্ড জ্যোতিষী - তান্ত্রিক দ্বারা অর্থ-লুটের কৌশল। তারা প্রশ্ন করতে শিখেছেন, যদি জন্মান্তরবাদ সত্য হয় তাহলে যারা হিরোশিমা, নাগাসাকি' তে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে মারা গেছেন, যাদের দেহের নামমাত্র চিহ্নটুকুও মেলেনি তাহলে তারা আবার জন্ম নিলে কোন অঙ্গ নিয়ে জন্ম নেবে? একই সময়, একই জায়গায় ঐ যে লাখ লাখ মানুষ মারা গেলেন তবে কী তাদের সবাইয়েরই পূর্বজন্মের কর্মফল এক ছিলো? ঐ লাখ লাখ মানুষ কী একই দিনে, একই তিথি-নক্ষত্র অনুসারে জন্মগ্রহণ করেছিলো? তাহলে ঐ বিস্ফোরণে যারা মারা গেছিলেন তারা সবাই একই বয়সের?
জানি প্রশ্নগুলোর উত্তর যুক্তিগত ভাবে খুব সহজ তাই তার বিশ্লেষণও সহজ। এই সমস্ত কুসংস্কারের অন্ধকারকে নস্যাৎ করে দিয়ে, কোনো দৃষ্টিহীন বা কোনো মৃত্যু পথগামীর জীবনে জীবনের আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে উঠুন। মরণোত্তর চক্ষুদান-দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।