আমারই ভুল আমাদের বাঙালি মেয়েদের, মেয়েদের বাইরে ভাবা। তারা কখনোই তাদের মেয়েলী পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতেই চায় না – এটা আমার বোঝা দরকার ছিল। আমি তাদের মুক্তির কথা বলি, ওরা শশক ছানার মতো ভয়ে মুখ লুকোয় গর্তের ভেতর। আসলে এরা বদ্ধতাটাকেই মুক্ত জীবনের আনন্দ;- এই মন ভোলানো বুলি আওড়ে আনন্দ পেতে চায়। এরা নিজেদের সুখ – দুঃখ অন্যের কাছে গচ্ছিত রেখে দিয়েছে। এদের সকল চিন্তা-ভাবনা অন্যের নাগপাশে আবদ্ধ। এরা হয় যেমন আছে যেমন থাকে ওটাকেই ভবিতব্য মনে করে কিংবা ওটাই ওদের পরিচয় বলে মনে প্রাণে মানে।
আমার বাঙালি মা’য়েরা আমার বাঙালি বোনের স্বাধীনতাকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। আসলে ওরা পায়নি যা তা এদের দেওয়াটাকেই বোধহয় বিড়ম্বনা মনে করে, না হয় মেয়ে হয়ে অপর মেয়ের প্রতি ঈর্ষা এই আদিম সত্যটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লাগে। তাই তো তারা তাদের মা-র কাছে প্রাপ্ত সংস্কারটাকে কোনোরূপ বিচার বিশ্লেষণ না করেই অন্ধভাবে তাদের মেয়েদের এবং সেই মেয়েরা তাদের কন্যাসন্তানদের মধ্যে চালিয়ে যেতে চায়। আসলে এরা এদের মনের মধ্যে গ্রথিত কোনো সংস্কারকে বিচার করাটাকেই পাপ মনে করে; মনে করে গুরুর ক্রোধ দৃষ্টির অধিকারী হবে।
গুরু, সেই গুরু যে আমাদের বাঙালি অন্ধ জড় সমাজের প্রতিমূর্তি; ইনিও জড়;- কিংবা জড়ের ভূমিকা পালনেই আনন্দিত হন; আসলে মনে হয় ইনি নিজেকে পথের মধ্যে হোঁচট খাওয়া অল্প গ্রথিত পাথরকে কথিত গভীর পাতালভেদী ভগবান শিবের মতো ভেবে থাকেন এবং নিজের শতজীবাণুদ্বারা আক্রান্ত পদরজকে অমৃত জল বলে বাঙালি বঙ্গ নারীকে খাওয়াতেও কুন্ঠাবোধ করেননা; বোধহয় মনে মনে আপ্লূত হন মহান কোনো পুণ্য কর্ম করলেন – এই ভেবে। ধিক! –
কিছুকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা মেয়ে কেন মানুষ শব্দটিরই অপমান করা। আর একারণেই তারা আবদ্ধ অন্ধ নামক শব্দটি দিয়ে। এর দূরীকরণ তখনই সম্ভব যখন এরা প্রকৃত আলোকে সত্য মনে করে মনের অন্ধ কুটিরের মধ্যে সঞ্চার করতে চাইবে।
প্রকৃত আলো, জ্ঞান (যথার্থ জ্ঞান) শব্দটিরই সমার্থক মাত্র। আর এই আলো দান করার জন্যই মশাল হাতে আমি ওদের মনের আঁধারে প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি; তারাও আমার অগ্রগতিকে তাদের মুক্তির পথপ্রদর্শক বলে শান্ত হয়ে বসেছে। এমন সময় আমার বঙ্গ মা’য়েরা হয়তো আমি তাদের মুখাগ্নি করতে চলেছি এইভেবে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আরও পূর্বের চেয়ে আরও জোরে তারা তাদের কন্যা শাবকদের সংস্কার নামক জংধরা মোটা শিকল দিয়ে বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।
আমার বঙ্গ মায়েদের কাছে এটাই অবেদন একবার ওদের ওই যথার্থ জ্ঞানের অমৃত পান করতে দেওয়া হোক। আমার বিশ্বাস ওরা যদি সত্যই তাদের কন্যার মঙ্গল কামনা করেন তাহলে তারা অবশ্যই পরে দেখতে পাবেন, তাদের জীবনে তারা যা পায়নি ইচ্ছা থাকা সত্বেও; তা এরা পেয়ে কতটা মঙ্গলকর জীবনযাপন করছে। খাঁচার বদ্ধ পাখি খাঁচার বাইরের জীবনে অসুরক্ষিত হতে পারে কিন্তু পাখির অন্তরের জীবন আমার বিশ্বাস খোলা আকাশ, ঘন গাছ পালার মধ্যেই প্রান বিসর্জন দিতে সদা প্রস্তুত থাকে এবং ওটাই তাদের আসল মুক্তি।
তাই ‘ওরা যে মেয়ে’ এই মিথ্যাছলের কথাকে ওদের কাছে সত্য জ্ঞানের ভুল মন্ত্র শিখিয়ে চিরকালের মতো পূজার্চনার মধ্যে বেঁধে পুরুষদের পশ্চাদগমনকারী সীতা করে না রাখায় ভালো। বরং ‘ওরাও মানুষ’ এই সত্য জ্ঞানের মন্ত্র দান করা হোক ওদের, তবেই মানুষ ও জাতীর ও দেশের মঙ্গল সম্ভব।
ফুলকুসমা, বারিকুল, বাঁকুড়া